ছেলেকে করোনা থেকে উদ্ধার করতে ১৪০০ কি.মি. পাড়ি দিলো মা

মায়ের পায়ের তলাকে বেহেশত এমনি এমনি বানায়নি খোদা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কত কিছুই না আমাদের দেখাল! স্বজনদের লাশ ফেলে পালানোর মতো ঘটনার সাক্ষী তো আমাদের এই বাংলাদেশই। তবে এর ব্যতিক্রমও কিন্তু অবশ্যই আছে। ভালোবাসা, সম্পর্ক, পরিবারের বন্ধন যে কতটা দৃঢ় হতে পারে, এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও আছে। আর তা দেখালেন ভারতের তেলেঙ্গানার রাজ্যের এক মা,  যার নাম রাজিয়া বেগম।  রাজিয়া বেগমের বাস নিজামবাদের বোধানে। বয়স ৪৮। একটি সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক তিনি। 
 
তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন হায়দরাবাদের নারায়ণা মেডিকেল একাডেমির শিক্ষার্থী। বয়স ১৯ বছর। গত ১২ মার্চ নিজামের সহপাঠী অসুস্থ বাবাকে দেখতে যান। সঙ্গে নিলেন নিজামকে। অবশ্য একটি দরগা জিয়ারতও ছিল নিজামের লক্ষ্য। ফিরতি টিকিট ছিল ২৩ মার্চ। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সবকিছু বদলে দেয়। ট্রেন বাতিল হয়, শুরু হয় লকডাউন। নিজম আটকা পড়েন বন্ধুর বাড়িতে।১৪০০ কিলোমিটার স্কুটি চালিয়ে লকডাউনে আটকে পড়া তরুণ ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে এনে রীতিমতো অসাধ্যসাধন করলেন এই মা।

রাজিয়া বেগম হায়দ্রাবাদ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে নিজামাবাদ সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। তিনি ১৫ বছর আগে স্বামীকে হারান। এরপর থেকে দুই ছেলেকে আগলে রাখেন। তার দুই সন্তানের একজন প্রকৌশলী গ্রাজুয়েট। অন্যজন ১৯ বছর বয়সী নাজিম উদ্দিন। যার কিনা চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন।
মায়ের অসামান্য মনোবল ও সাহসিকতায় মুগ্ধ ছেলে নিজাম উদ্দিন। অল্প বয়সে বাবাকে হারালেও মা-ই যে তাকে আগলে রেখে সে অভাব বুঝতে দেননি, তা স্বীকার করেছেন তিনি।

ছেলে নাজিমউদ্দিন অন্ধ্রপ্রদেশ এ স্কুলের হোস্টেলে থেকে পড়ে। বাবা মারা গেসে ১৪ বছর আগে। ছেলে আর মায়ের দূরত্ব ৭৩০ কিলোমিটার। ছেলে বাসায় আসতে পারেনি। কঠোর লক ডাউনে আটকে গেছে আর অস্থির হয়ে মাকে ফোন দিয়েছে। মায়ের মন আর টিকলো না। ট্রাফিক সদরে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে অনুমতি নিয়ে একটা স্কুটি করে বেরিয়ে পড়লো। 

গতকাল সকালে ছেলে নাজিম কে নিয়ে এই প্রচন্ড গরমে তিন দিন ধরে ১৪০০ কিলো টানা স্কুটি চালিয়ে বাসায় নিয়ে এসেছে মা রাজিয়া বেগম। দুই সন্তানের জননী রাজিয়া বেগম এর আগে স্কুটি চালিয়ে কখনোই শহরের বাইরে যাননি। করোনা সংক্রমণ থেকে ছেলেকে উদ্ধার করতে তিনি স্কুটিতে এক হাজার ৪০০ কিলোমিটার পাড়ি দিলেন।

ভারতের সংবাদপত্র ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’–এ রাজিয়া বেগমের তিন দিনের দুঃসাহসিক যাত্রার বিষয়টি উঠে এসেছে। তিনি ৬ এপ্রিল সোমবার সকালে যাত্রা শুরু করেন। ছেলেকে নিয়ে বাসায় ফেরেন ৮ এপ্রিল বুধবার সন্ধ্যায়। সাহসী এই নারীকে স্কুটি চালাতে হয় ২৩ থেকে ২৪ ঘণ্টা। এ হিসাবে ঘণ্টায় তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে ৬০ কিলোমিটারের মতো।

রাজিয়া বেগমের পরিবার, তাঁর স্কুটি যাত্রা এবং ফিরে আসার পুরো ঘটনাটা জানলে আসলেই বিশেষ কিছু মনে হতে পারে। আর এ জন্যেই এটি খবরের পাতায় উঠে এসেছে। এবার দেখা যাক রাজিয়া বেগমের যাত্রাটা  আসলেই কেমন ছিল—

ভারতের তেলেঙ্গানা প্রদেশের নিজামাবাদের বোধান থেকে অন্ধ্র প্রদেশের নেল্লোর। দূরত্ব ৭০০ কিলোমিটার হবে। আসা-যাওয়া ধরলে ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। ভারতের ট্রেন ব্যবস্থা কিংবা সড়ক বিবেচনায় নিলে তা কিছুই নয়। কিন্তু এটা তো স্বাভাবিক অবস্থার কথা! হ্যাঁ বলা হচ্ছে করোনাভাইরাসকালের কথা। অর্থাৎ লকডাউন যুগের কথা। যেখানে বাস, ট্রেন সবই বন্ধ। ভারতে ২৩ মার্চ থেকে বেশির ভাগ রাজ্যে লকডাউন শুরু হয়। এখনো তা বলবৎ আছে।

রাজিয়া বেগমের স্বামী মারা গেছেন ১৪ বছর আগে। তাঁর ভাবনায়, নেল্লোর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেশি। ছেলে হয়তো নিজে থেকে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনুসরণ করতে পারবেন না। এ জন্যে তাঁকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন। পুলিশের সহায়তা চাইলেন। কিন্তু লকডাউনের কড়াকড়ির কারণে বিফল হলেন।

 
রাজিয়া বলছিলেন, ‘আমি খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। সে বাসায় থাকলে আমি তাঁকে চোখে চোখে রাখতে পারতাম। এ জন্য পুলিশের পরামর্শে লকডাউন শিথিল হয় কি না, সেই আশায় আমি অপেক্ষা করছিলাম।’

কিন্তু রাজিয়াকে আরো  হতাশ হতে হয় ৫ এপ্রিল লকডাউন বাড়ানো হয়েছে। এবার রাজিয়া নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি নিজেই যাবেন এবং স্কুটিতে বসিয়ে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। যে কথা, সেই সিদ্ধান্ত। গত ৬এপ্রিল সোমবার  সকালে নিজের স্কুটিতে রওয়ানা দেন তিনি। কারণ, লকডাউনের মধ্যে কোনো গাড়িচালক রাজি হচ্ছিলেন না। 

এ ছাড়া গাড়ি নিয়ে গেলে মহাসড়কে পুলিশের বাধার মুখে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। রাজিয়া বলছিলেন, ‘আমি ২৫ বছর ধরে (টু হুইলার) স্কুটি চালাই। তাই স্কুটি চালানো নিয়ে ভীত ছিলাম না। কিন্তু দূরত্বটা আসলেই বেশি ছিল। আমার এই যাত্রার কথা আমি ছেলেকেও জানাইনি। এমনকি আমার ভাইবোন-আত্নীয়স্বজনদেরও না। আমি সোমবার সকালে যাত্রা করি এবং হায়দরাবাদের বাইরে গিয়ে ছেলেকে জানাই যে আমি তাকে নিতে আসছি।’

যাত্রাপথে রাজিয়া বেগম যেখানেই পেট্রলপাম্প পেয়েছেন,  সেখানেই জ্বালানি ভরে নিয়েছেন। এ ছাড়া একটি ক্যানে সব সময় বাড়তি জ্বালানি রেখেছেন। আর ক্ষুধা নিবারণের জন্য বহন করেন রুটি ও সবজি। রাজিয়া বলছিলেন, ‘আমি পেট্রলপাম্পে ১৫-২০ মিনিট বিরতি দিতাম। পানি পান করতাম। আর স্কুটির ইঞ্জিনটিকে ঠান্ডা হওয়ার সুযোগ দিতাম। আমার  ভাগ্যটা ভালো যে, স্কুটিটি মাঝপথে বিকল হয়নি।’

রাজিয়া যখন তেলাঙ্গানা অন্ধ প্রদেশ সীমান্তে পৌঁছান, তখন সন্ধ্যা হওয়ার পথে। তাঁর যাত্রা শুরু এবং গন্তব্যের কথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভড়কে যান। কারণ, মহাসড়কে আর কোনো যানবাহন নেই। নিরাপত্তার কথা বলে ফেরত যেতে বলেন। কিন্তু রাজিয়া তাদের বোঝাতে সক্ষম হন যে তিনি নিরাপদ পথ চলতে পারবেন।

রাজিয়া বলছিলেন, ‘মহাসড়ক ছিল অন্ধকার এবং সুনসান। কিন্তু আমাকে আমার ছেলেকে আনতে যেতেই হবে। রাত ২টার দিকে পুলিশ চেক পয়েন্টে থামায়। তারা আমার উদ্দেশ্যে সম্পর্কে শোনে। সামনের সড়ক খুবই বিপজ্জনক উল্লেখ করে সেখানেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরামর্শ দেয়। চেকপোস্টের কাছে কিছুক্ষণ আশ্রয় নিয়ে রাত চারটায় রওনা করি। তখন ছেলেকে ফোনে জানায় আমি কাছাকাছি চলে এসেছি।’

ছেলে নিজামউদ্দিন মায়ের সম্পর্কে বলেনঃ সকাল সাড়ে ৭টার দিকে তাঁর মা তাঁকে নিতে আসেন, ‘আমাকে নেওয়ার জন্য ২৩-২৪ ঘণ্টা স্কুটি চালিয়েছেন। আমি তাঁকে দেখে বিহ্বল ও আনন্দিত ছিলাম। ওই দিনই বিকেলে আমরা ফিরতি যাত্রা শুরু করি। বুধবার সন্ধ্যায় বোধানে ফিরে আসি। তখনই মা দুই দিন পর ঠিকমতো খাবার গ্রহণ করেন।’

বোধানের সহকারী পুলিশ কমিশনার ভি জয়পাল রেড্ডি বলেন, ‘রাজিয়া খুবই সাহসী একজন নারী। আমি তাঁকে একটা গাড়ি ভাড়া করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এত টাকা খরচ করতে পারবেন না বলে তিনি স্কুটিতেই যেতে চাইলেন। তিনি তাঁর এই যাত্রার উদ্দেশ্য লিখে একটি কাগজ দেওয়ার অনুরোধ করলেন, যাতে পথে পুলিশ আটকালে দেখাতে পারেন। আসলে তাঁর সাহসেই তিনি আটকে পড়া ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন।’

 দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দিন-রাত দুই চাকার স্কুটি ছোটালেন সাহসিনী। অসম্ভব মনের জোর কাজে লাগিয়ে গুগল ম্যাপেএর সাহায্যে পৌঁছে যান ছেলের কাছে। 

 দুই সপ্তাহ আগে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের নেলোর জেলায় রেহমতাবাদ শহরে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যান দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র তেলাঙ্গনার বোধান শহরের বাসিন্দা মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন। গত ২৩ মার্চ বাড়ি ফেরার ট্রেনের টিকিট কাটা থাকলেও ভারতজুড়ে লকডাউন জারি হওয়ায় তিনি বন্ধুর বাড়িতেই আটকা পড়েন।
সাহায্য চেয়ে বোধানের সহকারি পুলিশ কমিশনার ভি জয়পাল রেড্ডির দ্বারস্থ হন রাজিয়া। পুলিশ কর্মকর্তা তাকে অনেক বুঝিয়ে নিরস্ত করার চেষ্টা করলেও পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে নিজের স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন প্রধান শিক্ষিকা। ঠিক করেন এক হাজার ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ছেলেকে উদ্ধার করে বাড়ি ফিরিয়ে আনবেন। সঙ্গে নেন পুলিশ সহকারি প্রধানের অনুমতিপত্র।

গত ৬ এপ্রিল ভোরে রওনা দেন রাজিয়া। পথে বিভিন্ন জায়গায় তাকে পুলিশের ব্যারিকেডে থামতে হলেও অনুমতিপত্র দেখিয়ে ছাড়া পান রাজিয়া। পুলিশ সদস্যরা তার মনোবল ও সাহস দেখে অবাক হন। তিনি পথে পেট্রল নেয়াসহ কয়েকবার অল্প সময়ের জন্য বিশ্রাম নেন।

৭ এপ্রিলই দুপুরে ফের ছেলেকে নিয়ে নেলোর ছাড়েন রাজিয়া। ৮ এপ্রিল সকালে পৌঁছে যান নিজের বাড়ি। দীর্ঘ পথ স্কুটি চালিয়ে প্রচন্ড ক্লান্ত মা জানান, ছেলেকে উদ্ধার করার তীব্র বাসনাই তাকে এই অসম সাহসিকতায় উদ্বুদ্ধ করেছে। রাজিয়া বেগমের কীর্তিকে স্যালুট জানিয়েছেন বোধান শহরের সহকারি পুলিশ কমিশনার ভি জয়পাল রেড্ডিও।
আমাদের এ লেখাটি যাদ আপনার ভালে লাগে, তাহলে অবশ্যই আমাদের ফেসবুক পেজ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথে থাকবেন। যদি আরো কিছু জানার থাকে তাহলে আমার এই পোস্টের নিচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করবেন, আমি আমার সাধ্যমত আপনাদেরকে সঠিক তথ্যটি জানানোর চেষ্টা করব। আমাদের ফেসবুক পেজ এ লাইক বাটন ক্লিক করে পরবর্তী নিউজের সাথে আপডেট থাকবেন। বন্ধুদের সাথে পোস্টটি শেয়ার করতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ সবাইকে। ভালো থাকবেন আল্লাহ হাফেজ।
Image Source: www.google.com






Previous Post Next Post

نموذج الاتصال