ভূমিকাঃ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান অন্যান্য ধর্ম ও জাতির তুলনায় অনেক বেশি। ইসলামের সূচনা থেকেই শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে মুসলমানদের যাত্রা শুরু হয়। মুসলিম র্দাশনিকদের সৃষ্টিশীল প্রতিভার ফলেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অভাবনীয় সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলমানঃ বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখায় মুসলমানদের অবদান রয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে ইসলাম ধর্ম মর্যাদা দান করেছে। ফলে যুগে যুগে অনেক মুসলিম মনীষী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। মানবিক জীবনের যাবতীয় সমাধান পবিত্র গ্রন্থ কোরআন শরীফে রয়েছে। কোরআনকে পর্যবেক্ষণ করে মানবতার কল্যাণে মুসলিম বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন বিষয় আবিষ্কার করেছেন। চিকিৎসাশাস্ত্র, রসায়নশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা প্রভৃতিতে মুসলিম মনীষীদের ব্যাপক অবদান লক্ষণীয়।
চিকিৎসাশাস্ত্রঃ জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো চিকিৎসা বিজ্ঞান। শরীর সম্পর্কিত বিদ্যা হলো চিকিৎসা বিজ্ঞান। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা ও উৎকর্ষ সাধনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসাশাস্ত্রে বিভিন্ন মুসলিম মনীষীগণ বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তাদের মধ্যে ইবনে সিনা, আল-রাজী, আল-কিন্দি, আলী আত তাবারী, ইবনে রুশদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
ঔষধশাস্ত্রঃ মুসলমানগণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে ঔষধ শাস্ত্রে ব্যাপক অবদান রাখে। তারা নিজেরা বিভিন্ন রোগের ঔষধ তৈরি করতো। তাছাড়া ঔষধ তৈরি এবং বিভিন্ন রোগের সমাধান প্রসঙ্গে বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন। যেমন ইবনে সিনা কানুন-ফিত-তিব্ব, আল রাজী কিতাবুল মনসুরী, আলবেরুনী কিতাব আস সায়দালা প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন।
মস্তিষ্কে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ঝিল্লির প্রদাহ: চিকিৎসাশাস্ত্রের কথা বলতে গেলে যার নাম সর্বপ্রথম আসে তিনি হলেন ইবনে সিনা। তাকে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক বলা হয়। তিনিই সর্বপ্রথম মস্তিষ্কে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ঝিল্লির প্রদাহ সম্পর্কে গবেষণা করেন। তাছাড়া তিনি যক্ষা রোগের সংক্রামক, প্রকৃতি, প্রাণী ও মৃত্তিকা দ্বারা রোগ বিস্তারের ধারণা ও কৃমি রোগ সম্পর্কে আলোচনা করেন।
অস্ত্রোপচারঃ মুসলিম বিজ্ঞানী আল-রাজী সর্বপ্রথম অস্ত্রোপচার বিষয়ে আধুনিক ভাবনা উদ্ভাবন করেন।
চক্ষু চিকিৎসায়ঃ মুসলমানগণ চক্ষু চিকিৎসায় বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন। চক্ষু চিকিৎসাবিদ আম্মারের গ্রন্থ- আল মুস্তাখাব-আল আইন গ্রন্থে চক্ষুরোগ ও সেগুলোর চিকিৎসার বিবরণ পাওয়া যায়।
বিভিন্ন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাঃ সঠিক চিকিৎসা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা এবং ব্যবহারিক জ্ঞানর্চচার স্বার্থে বিভিন্ন স্থানে হাসপাতাল গড়ে তোলে মুসলমানরা। তার মধ্যে বাগদাদের আদুরী জুন্দিমাপুর হাসপাতাল, দামেস্কের নুরী ও আল মনসুরী হাসপাতাল উল্লেখযোগ্য।
রসায়নশাস্ত্রঃ বিজ্ঞানের সর্ববৃহৎ ও প্রধান শাখার নাম রসায়ন। রসায়নশাস্ত্রের জনক বলা হয় জাবির ইবনে হাইয়ানকে। রসায়নশাস্ত্রে বিভিন্ন মুসলিম মনীষী অবদান রাখেন। তাদের মধ্যে জাবির ইবনে হাইয়ান, খালিদ বিন-ইয়াজিদ, জাকারিয়া আল রাজী, আল-জিলদাকী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
যৌগিক সূত্র আবিষ্কারঃ জাবির ইবনে হাইয়ান প্রথম যবক্ষার এসিড, গন্ধক, দ্রাবক, জল দাব্রক, রৌপ্যক্ষার ও অনান্য যৌগিক সূত্র আবিষ্কার করেন। তাছাড়া তিনি ভস্মীকরণ ও লঘুকরণকে বৈজ্ঞানিক নিয়মে আলোচনা করেছেন।
ডিমের পানি প্রস্তুতকরণঃ একাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত রসায়নবিদ ইমাম জাফর আস-সাদিক সর্বপ্রথম রসায়ন শাস্ত্রের আলোকে ডিমের পানি প্রস্তুতকরণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
ধাতুর পরিবর্তনঃ মুসলিম মনীষী আবুল কাশেম আল ইরাকী সর্বপ্রথম ধাতুর পরিবর্তন সর্ম্পকে ধারণা দেন।
গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনাঃ রাসায়নশাস্ত্রের বিভিন্ন খুটিঁনাটি বিষয় সম্পর্কে মুসলিম মনীষীগণ বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে রসায়নশাস্ত্রের মূল্যবান তথ্যসম্ভার। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কিতাবুল আসার, কিতাবুল শাওয়াহিদ, কাশফুস সুতুর, কিতাবুল হারাবাত প্রভৃতি।
জ্যোতির্বিদ্যাঃ জ্যোতির্বিদ্যা হলো মহাকাশ সম্পর্কীত বিজ্ঞান। গ্রহ, নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য ও অলৌকিক বস্তু সমূহের গতিবিধি নিয়ে যে শাস্ত্র আলোচনা করে তাকে জ্যোতির্বিজ্ঞান বলে। পৃথিবীর গতিবিধি, অক্ষাংশের পরিবর্তন, ধূমকেতুর রূপ নির্ণয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান ঈর্ষনীয়। জ্যোতির্বিদ্যার উৎকর্ষ সাধনে যে কজন অবদান রেখেছে তাদের মধ্যে আল মনসুর, আন মামুন, আবু মাশার, আল খারেজমী, আবুল হাসান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
মান মন্দির স্থাপনঃ মুসলমানগণই সর্বপ্রথম ইউরোপে মান মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে মুসলমানরা মান মন্দির প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি অবলোকন করে জ্যোতির্বিজ্ঞান শাস্ত্রের ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন।
মানচিত্রের ধারণাঃ বিশ্ব মানচিত্রের প্রথম ধারণা দেন মুসলিম মনীষী আল-খারেজমী। পরবর্তীতে এটিই বিশ্ব মানচিত্রের মডেল হিসেবে স্বীকৃত হয়।
বর্ষপঞ্জি ও নক্ষত্রঃ উমর খৈয়াম প্রথম বর্ষপঞ্জি প্রনয়ণ করেন। পরবর্তীতে আল-বাত্তানী সর্বপ্রথম নক্ষত্রের চার্ট তৈরি করেন।
উদ্ভিদবিদ্যাঃ উদ্ভিদবিদ্যায় মুসলমানদের অবদান অপরিসীম। উদ্ভিদবিদদের মধ্যে ইবনে বাতরের নাম উল্লেখযোগ্য। লতাপাতা সম্পর্কিত তাঁর তথ্যবহুল গ্রন্থটি আজও সকলের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তাছাড়া মুসলমানরা ভূতত্ত্ব ও প্রাণিতত্ত্বে উন্নতি সাধন করেছিলেন।
পর্দাথবিদ্যাঃ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার ন্যায় মুসলমানরা পর্দাথবিদ্যায় ব্যাপক অবদান রেখেছেন। পর্দাথবিজ্ঞানে যেসব মনীষী অসামান্য অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে ইবনে রুশদ, আলবেরুনী, আল-খারেজমী, ইবনুল হাইসাম প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। পর্দাথবিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে তামহিদুল মুসতাকাররে লিমানিল মামারবে, কিতাবুল মানায়িব, রিসালাতু ফিশাশফক প্রভৃতি।
গণিতশাস্ত্রঃ গণিতশাস্ত্রের প্রচলন, অগ্রগতি, ও উৎকর্ষতায় মুসলমানদের অবদান অনস্বীকার্য। যারা গণিতশাস্ত্রকে উন্নতির আসনে বসিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছে- আল বেরুনী, আল-খারেজমী, আল-কারখী, ওমর খৈয়াম, আবুল ওয়াদা প্রমুখ।
সংখ্যাবাচক চিহ্নঃ মুসলিম গণিতবিদ আল খারেজমী সর্বপ্রথম সংখ্যাবাচক চিহ্নের ব্যবহার বিষয়ে ধারনা দেন। গণিতশাস্ত্রের উপর তার বিখ্যাত গ্রন্থ হলো কিতাবুল হিন্দ। এখানে তিনি গণিতের বিভিন্ন জটিল বিষয়ের সমাধান দেখিয়েছেন।
দূরত্ব নির্ণয়ঃ বিজ্ঞান ও গণিত জগতের এক অনন্য নাম ইবনুল হাইশাম। তিনিই প্রথম জ্যামিতিক গণনার সাহায্যে পৃথিবীর যেকোনো দুটি স্থানের মধ্যে দূরত্ব নির্ণয় করেন।
সমুদ্র সূর্য ও নক্ষত্রঃ মুসলিম বিজ্ঞানী আল-ফারাবী সর্বপ্রথম সমুদ্রে সূর্য ও নক্ষত্র সমূহের উচ্চতা নির্ণয় করার আস্তারলব নির্মান করেন।
স্থাপত্যবিদ্যাঃ মুসলিম জাতির শৈল্পিক পরিচয় পাওয়া যায় স্থাপত্য শিল্পের মাধ্যমে। হযরত মুহাম্মদ (স.) মদিনা মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে মুসলিম স্থাপত্য বিদ্যার গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন মুসলিম মনীষীগণ স্থাপত্য শিল্পের বিশেষ অবদান রাখেন।
বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠাঃ মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাসে বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। খলিফা আল মনসুরের এ নগরী প্রতিষ্ঠা করতে প্রায় ৪০ লক্ষ দিরহাম খরচ করতে হয়েছিল।
দামেস্ক জামে মসজিদঃ ইসলামের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মসজিদ বলা হয় দামেস্ক জামে মসজিদকে। দামেস্ক মসজিদেই সর্বপ্রথম ট্রানসেপ্ট ব্যবহৃত হয়।
আনজারঃ খলিফা ওয়ালিদের আমলে বৈরুত রাস্তার পাশে আনজার প্রসাদ নির্মিত হয়। একে উমাইয়া বংশের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শনও বলা হয়।
উপসংহারঃ মুসলমানদের বিভিন্ন আবিষ্কার, গবেষণাকর্ম ও সূত্রের সাহায্যে বিজ্ঞানকে করেছে সমৃদ্ধশালী। বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান বর্ণনাতীত। যদিও মুসলমানদের কৃতিত্বের অনেক কিছুই ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বাদ পড়েছে। কিন্তু একথা সবাইকে স্বীকার করতে হবে যে মুসলমানরা আধুনিক বিজ্ঞানের সফল পথিকৃৎ।
আমাদের এ লেখাটি যাদ আপনার ভালে লাগে, তাহলে অবশ্যই আমাদের ফেসবুক পেজ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথে থাকবেন। যদি আরো কিছু জানার থাকে তাহলে আমার এই পোস্টের নিচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করবেন, আমি আমার সাধ্যমত আপনাদেরকে সঠিক তথ্যটি জানানোর চেষ্টা করব। আমাদের ফেসবুক পেজ এ লাইক বাটন ক্লিক করে পরবর্তী নিউজের সাথে আপডেট থাকবেন। বন্ধুদের সাথে পোস্টটি শেয়ার করতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ সবাইকে। ভালো থাকবেন আল্লাহ হাফেজ।
Image Source: www.google.com