রচনাঃ বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প

(সংকেত: ভূমিকা; পর্যটনের সংজ্ঞা; বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্র; বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব; বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সমস্যাসমূহ; বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে করণীয়; উপসংহার।) 
ভূমিকাঃ বিনোদনের উৎস হিসেবে মানুষ যতগুলো মাধ্যম বেছে নেয় ভ্রমণ তার মধ্যে অন্যতম। আর ভ্রমণ পিপাসু মানুষের নিত্য চাহিদার উপর ভিত্তি করে পৃথিবী জুড়ে গড়ে উঠেছে হাজারো পর্যটন কেন্দ্র। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে আয়ের অন্যতম উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অবিরাম চেষ্টা চলছে। আর এই চিন্তা চেতনা থেকেই পর্যটন গড়ে উঠেছে শিল্প হিসেবে। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশে পর্যটকদের আগমন আজও ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের অন্যতম একটি উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে পর্যটন শিল্প।



পর্যটনের সংজ্ঞাঃ অল্প কথায় বা নির্দিষ্ট কিছু মানদন্ডের আলোকে পর্যটনকে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। কারণ একেকজনের দৃষ্টিতে পর্যটন একেক রকম। সহজ কথায়, পার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করার উদ্দেশ্যে মানুষের দর্শনীয় স্থানে অবস্থান এবং এর সাথে সম্পর্কযুক্ত কর্মকা-কে পর্যটন বলে। পর্যটনকে কেন্দ্র করে যখন অর্থনীতি আলাদা একটি গতি পায় তখন তাকে বলে পর্যটন শিল্প। আন্তর্জাতিক পর্যটন বিশেষজ্ঞ সংস্থার সংজ্ঞানুযায়ী ‘পর্যটন হলো কোনো উপার্জনমূলক কাজে যুক্ত নয় এবং স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে না এমন ব্যক্তির ভ্রমণ এবং কোথাও থাকা থেকে উৎসারিত প্রপঞ্চ এবং সম্পর্কের সমষ্টি।’
  
বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রঃ নানা নান্দনিক সৌন্দর্যের কেন্দ্র হলো বাংলাদেশ। এদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো নানা বৈচিত্র্যের সমাহার। কোনোটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনোটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত আবার কোনোটি ধর্মীয় ঐতিহ্যের নান্দনিক স্মারক হয়ে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যে দেশ, ঐতিহ্যগত, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং আত্মিক সকল সম্পদ দিয়েই সমৃদ্ধ। এ কারণে সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে পর্যটকদের আগমন ঘটছে। ইতিহাস খ্যাত পর্যটক ফা হিয়েন, হিউয়েন সাং, ইবনে বতুতার পর্যটক হয়ে আসার কাহিনী সবার জানা। বাংলাদেশে পর্যটন কেন্দ্রগুলো বৈচিত্র্যময় হওয়ার কারণে পর্যটকদের মধ্যেও বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়।

নিম্নে বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর নাম, অবস্থান ছকের সাহায্যে তুলে ধরা হলো-
পর্যটন কেন্দ্রের নাম বিখ্যাত হওয়ার কারণ  অবস্থান
১. সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। খুলনা
২. কক্সবাজার  পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত।  কক্সবাজার
৩. সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের একমাত্র সামুদ্রিক প্রবাল দ্বীপ। কক্সবাজার
৪. কুয়াকাটা  এক জায়গায় থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখার জন্য বিখ্যাত স্থান।  পটুয়াখালী
৫. মহাস্থানগড় প্রাচীন এবং প্রত্মতাত্বিক নিদর্শনের জন্য বিখ্যাত। বগুড়া
৬. সোনরগাঁও লোকশিল্পের জন্য বিখ্যাত। নারায়ণগঞ্জ
৭. পাহাড়পুর/সোমপুর বিহার বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শনের জন্য বিখ্যাত। নওগাঁ
৮. মাধবকুন্ড বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক জলপ্রপাত। সিলেট
৯. শিলাইদহ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের অনেকাংশ কাটিয়েছেন এই স্থানে। এখানে তার কুঠিবাড়ি রয়েছে। কুষ্টিয়া
১০. ষাটগম্ভুজ মসজিদ মধ্যযুগে ইসলামী সংস্কৃতির গঠন প্রণালী ও স্থাপত্য কৌশলে এটি একটি অনন্য সৃষ্টি। বাগেরহাট
১১. সীতাকোট বিহার প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার।  দিনাজপুর
১২. ময়নামতি প্রত্নতাত্মিক স্থান  কুমিল্লা

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্বঃ বর্তমান সময়ের দ্রুত বিকাশমান একটি শিল্প হলো পর্যটন শিল্প। এ শিল্প তার বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পে উপার্জন বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে ১৯৯৯ সালে পর্যটন খাত থেকে বাংলাদেশের আয় হয়েছিল ২৪৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এটি বেড়ে গিয়ে ২০০৮ সালে ৬১২ কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। বাংলাদেশের GDP-এর প্রায় ২ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। পর্যটন শিল্পে প্রায় দশ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০১২ সালে মোট জিডিপির ৪.৩ শতাংশ এসেছে পর্যটন খাত থেকে টাকার অংকে যা প্রায় ৩৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এ ছাড়া কেবল ২০১২ সালেই পর্যটন খাতের সাথে জড়িত ছিল ১২ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। যা মোট চাকরির ১.৮ শতাংশ। (সুত্রঃ WOTTC Report 2012)


বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পের সমস্যাসমূহঃ বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় নিয়ামক পর্যটন শিল্প নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের সুষ্ঠু বিকাশ হচ্ছে না। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সমস্যাগুলো হলো-

১) রাজনৈতিক অস্থিরতাঃ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাই পর্যটন শিল্পের জন্য বড় হুমকি। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত থাকার কারণে এ দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

২) যোগাযোগ এবং অবকাঠামোগত সমস্যাঃ পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যাওয়ার মতো যেমন আরামদায়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব ঠিক তেমনি সেখানকার আবাসন ব্যবস্থাও ভালো নয়। তাই পর্যটন কেন্দ্রগুলো আকর্ষণীয় হলেও পার্যটকরা যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

৩) আকর্ষণীয় প্রচারণার অভাবঃ পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সৌন্দর্য নিয়ে আকর্ষণীয় প্রচারণা চালানো হয় না। ফলে সৌন্দর্য পিপাসু মানুষ এসব আকর্ষণীয় স্থান সম্পর্কে জানতে পারে না।

৪) দক্ষ গাইডের অভাবঃ বিদেশি পর্যটকদেরকে পথ দেখানো থেকে শুরু করে পর্যটন কেন্দ্র সম্পর্কিত ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য যে দক্ষ গাইডের প্রয়োজন বাংলাদেশে তার বড়ই অভাব। দোভাষী গাইডের সংখ্যা যতো বৃদ্ধি করা যাবে বাংলাদেশে ততো বেশি বিদেশি পর্যটক আসবে।

৫) সরকারি উদ্যোগের অভাবঃ বাংলাদেশের সরকার পর্যটনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে সব সময়ই অবহেলা করে এসেছে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকার কথা থাকলেও স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও তা সম্ভব হয়নি।

৬) বেসরকারি উদ্যোগের অভাবঃ বাংলাদেশের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে খুব কমই আছেন যারা পর্যটন শিল্পের দিকে মনোযোগ দিয়ে থাকেন। প্রায় সব দেশেই পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ হয়েছে সে দেশের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উদ্যোগে। কিন্তু বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করার সুষ্ঠু পরিবেশ এবং নিশ্চিত নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে পর্যটন খাতে বিনিয়োগ করতে চান না।
৭) পর্যাপ্ত এবং উন্নত প্রশিক্ষণের অভাবঃ পর্যটকদের বারবার আকৃষ্ট করার জন্য পর্যটন কেন্দ্রের সাথে সম্পৃক্ত সকল কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের উন্নত এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে এ ধরণের ব্যবস্থা খুবই সীমিত।

৮) নিরাপত্তার অভাবঃ বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প নিরাপত্তার অভাব পরিলক্ষিত হয়। খবরের কাগজে প্রায় খবর আসে বিদেশীরা বিভিন্নভাবে প্রতারিত বা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পূর্ণ নিরাপত্তার অভাবের কারণে বিদেশীরা অনেক সময় বাংলাদেশে আসেন না।
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে করণীয়ঃ বাংলাদেশের উন্নয়নের গতির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য পর্যটন শিল্পের সমৃদ্ধি প্রয়োজন। এ জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে-

১) পর্যটন নীতিমালার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করতে হবে।
২) পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে সহজে পৌঁছা যায় এমন যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৩) বিদেশি পর্যটকরা যাতে নির্বিগ্নে অবস্থান করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪) পর্যটন বিষয়ে ব্যাপক গণশিক্ষা এবং স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পর্যটন বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে।
৫) প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষতা সম্পন্ন পর্যটক গাইড (Tourist Guide) গড়ে তুলতে হবে।
৬) পরিবহন খাতের ঝুঁকি কমাতে হবে। যাতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা কোনো ঝামেলা ছাড়াই বিমান, লঞ্চ, বাস বা অন্যান্য যানবাহনে করে পর্যটন কেন্দ্রে পৌঁছতে পারে।
৭) সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।
৮) বাংলাদেশের প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্যগুলোকে প্রচারণার মাধ্যমে উপস্থাপন করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে হবে।
৯) সর্বোপরি দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।

উপসংহারঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতকে শক্তিশালী করার জন্য পর্যটন শিল্পের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। এ শিল্পের বিকাশের পথের বাধাগুলোকে দূর করে একে শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন কার্যকর উদ্যোগ, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং আন্তরিক প্রচেষ্টার। এ শিল্পের বিকাশ শুধু অর্থনৈতিক লাভের জন্যই নয় বরং দেশের ভাবমূর্তির বিষয়টিও এর সাথে জড়িত। উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম একটি খাত হিসেবে পর্যটনকে প্রতিষ্ঠা করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

আমাদের এ লেখাটি যাদ আপনার ভালে লাগে, তাহলে অবশ্যই আমাদের ফেসবুক পেজ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথে থাকবেন। যদি আরো কিছু জানার থাকে তাহলে আমার এই পোস্টের নিচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করবেন, আমি আমার সাধ্যমত আপনাদেরকে সঠিক তথ্যটি জানানোর চেষ্টা করব। আমাদের ফেসবুক পেজ এ লাইক বাটন ক্লিক করে পরবর্তী নিউজের সাথে আপডেট থাকবেন। বন্ধুদের সাথে পোস্টটি শেয়ার করতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ সবাইকে। ভালো থাকবেন আল্লাহ হাফেজ।
Image Source: www.google.com
Previous Post Next Post

نموذج الاتصال