রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “দুই বিঘা জমি” কবিতার ব্যাখ্যা ও অনুবাদ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "দুই বিঘা জমি" একটি বিখ্যাত কাব্যকথারূপ কবিতা। এটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধপূর্ণ কবিতা। কবিতাটি একজন দরিদ্র কৃষকের করুণ কাহিনি তুলে ধরে, যে জমি হারিয়েও তার প্রতি গভীর ভালোবাসা হারায় না।

নিচে "দুই বিঘা জমি" কবিতার পূর্ণ পাঠ দেওয়া হলো:


📝 দুই বিঘা জমি

— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মহাপুরুষের দেশে
বড় লোকের আশীর্বাদে জমি গেল শেষে।
হাটে যাবার পথ,
বাঁধতে দিলে না আর বাঁধাল বাঁশের ঘর।
বলিল, ‘‘এখন আর তোমার সেই দুখুমুখো
দুই বিঘে জমির মাঝে ঘরের বুকে সুখো!’’
জমিন উজাড় গেল, তবু
তোমার মনটা যেন সে দুই বিঘে রত্নভান্ডার।

চাষ করতেম, ঘাম ঝরত,
ধানের ছড়ায় সোনা ঝরত,
জমির কোলে শুয়ে থাকি
দেখতেম আকাশের তারা,
জমিন ছিল মা–
তাকে রেখে গেলেম যে কোথায়।

তবু দিন যায়,
পেটের দায়ে ভিন রাজ্যে যেতে হই কাজের আশায়।
চাষির বুকে কত আশা, কত জ্বালা,
তবু সংসার চলে, মন চলে গরু, লাঙল, আর জোয়ালায়।

অনেক দিন পরে
ফিরে এলেম আবার এই গাঁয়ের ধারে।
দেখিনু মনের সেই দুই বিঘা জমি
বড়লোকের বাগান হয়েছে,
তাতে ফুল ফোটে, পথ দিয়ে যায় ঘোড়া-গাড়ি,
আমার সে-জমি আমি চিনিনে আর।

তবু একদিন বাগানে ঢুকে পড়লেম চুপে,
হঠাৎ ধরা পড়লেম রাজভৃত্যের রূপে।
বলিল, ‘‘কে রে? চোর!’’
লাথি দিয়ে বলিল, ‘‘আহা! ভিখিরি লোক, দূর হতচ্ছে জোর!’’
আমি কেবল বলিনু, ‘‘এই সেই জমি, দুই বিঘা জমি,
এখনকার বাগান, ছিল আমার ঘরভুমি!’’
ভিখিরিরে কে শোনে?
তারে তাড়াইল রাজপুরুষ ঠেলি ক'রে কোণে।


📌 কবিতার তাৎপর্য:

এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুলে ধরেছেন:

  1. সাধারণ মানুষের জমির প্রতি আবেগ ও ভালোবাসা
  2. সামাজিক বৈষম্য ও জমিদারি শোষণ
  3. ভূমিহীন মানুষের অপমান ও অসহায়ত্ব

নিচে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "দুই বিঘা জমি" কবিতাটির সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা ও অনুবাদ দেওয়া হলো:


🔍 সহজ বাংলা ব্যাখ্যা:

এই কবিতায় একজন গরিব চাষির মর্মান্তিক গল্প বলা হয়েছে, যার দুই বিঘা জমি ছিল তার জীবনের একমাত্র সম্বল। এই জমিতেই সে চাষ করত, ঘর বানিয়ে থাকত, সুখ-দুঃখ ভাগ করত। জমির প্রতি তার ছিল গভীর ভালোবাসা — জমি শুধু সম্পত্তি নয়, ছিল তার আত্মার এক অংশ।

কিন্তু ধনী ব্যক্তি ও সমাজের অন্যায় ব্যবস্থার কারণে সে জমি ছিনিয়ে নেওয়া হয়। চাষিকে তার নিজের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। জমি চলে যায় এক বড়লোকের হাতে, সে সেখানে বাগান করে। চাষি বাধ্য হয়ে ভিন রাজ্যে পেটের দায়ে শ্রমিক হিসেবে চলে যায়।

অনেক বছর পর একদিন সে ফিরে আসে নিজের সেই চেনা গ্রামে। দেখতে পায় তার প্রাণের জমি এখন বড়লোকের ফুলের বাগান। আবেগে সে চুপিচুপি বাগানে ঢোকে, পুরনো স্মৃতি ফিরে পেতে চায়। কিন্তু তাকে চোর ভেবে রাজপুরুষেরা অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। সে বলেও, “এই দুই বিঘা জমি আমার ছিল!”, কিন্তু কেউ তার কথা শোনে না। জমিহীন গরিব মানুষের কথা সমাজে কেউ শোনে না—এটাই বাস্তবতা।


🌐 সংক্ষিপ্ত অনুবাদ (ইংরেজিতে):

Title: "Two Bighas of Land"
By Rabindranath Tagore (Translated Summary)

In a land ruled by the powerful, a poor farmer loses his tiny piece of land — only two bighas — due to the influence of a rich landlord. That land was everything to him: his home, his livelihood, his joy.

Forced to leave his village, he wanders to a distant place for work. Years later, when he returns to his village, he sees that his land has been turned into a rich man's garden. Overwhelmed by emotion, he sneaks into the garden, only to be beaten and driven away like a thief.

He cries, "This was my land once!" But no one listens — because in the eyes of society, a poor man’s memories, rights, and love for land have no value.


📚 মূল বার্তা:

  1. জমির সাথে কৃষকের আত্মিক সম্পর্ক
  2. সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য
  3. ভূমিহীন মানুষের দুর্দশা
  4. হারানো স্মৃতি আর নিজের জায়গায় পর হয়ে যাওয়া

🌾 ছড়ারূপ: দুই বিঘা জমি

দুই বিঘা জমি ছিল, ছোট্ট এক মাঠ,
চাষ করত কৃষক ভাই, ছিল না ঘাট।
ঘাম ঝরিয়ে ধান ফলাত, হাসত মুখ,
সেই জমিতেই ছিল তার স্বপ্ন-সুখ।

একদিন এলো এক ধনী বড়লোক,
বলল, “তোর জমি আমি নেব ঠিক!”
আইন-কানুন ঘুরিয়ে সে জমি নিল,
চাষির ঘর ভেঙে দিল, মন কেঁদে মিলল।

চাষি তখন চলল দূরে কাজের খোঁজে,
মন পড়ে রইল তার সেই মাঠের পোঁজে।
দিন কেটে গেল, ফিরে এলো সে আবার,
দেখল সেই জমি, আজ বাগান অপরূপ সাজার!

চুপিচুপি ঢুকে গেল গাছের মাঝে,
মনে পড়ে তার সুখের সব সাঁঝে।
কিন্তু ধরা পড়ল, বড়লোকের লোক
তাড়িয়ে দিল চিৎকারে, দিল গায়ে ধোক!

চাষি বলল, “এই ছিল আমার জমি ভাই!”
কেউ শুনল না, শুধু হেসে দূরে ঠেলাই।
ভালোবাসা, ঘাম-ঝরা মাঠের স্মৃতি,
সব হারিয়ে আজ সে শুধু কান্নার গীতি।

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال